আন্তর্জাতিক ডেক্স।। আগামী ১৬ই জুন জেনেভায় রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন যখন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সাথে শীর্ষ বৈঠকে বসবেন, বন্ধুত্বপূর্ণ সাক্ষাৎ হবে না সেই বৈঠক।
”অবন্ধু-সুলভ দেশের” তালিকায় সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের নাম যোগ করেছে রাশিয়া।
দুই দেশই একই কথা বলছে, তাদের মধ্যকার সম্পর্ক এখন প্রায় তলানিতে পৌঁছেচে। এমনকি কোন দেশেই এখন কারো রাষ্ট্রদূত নেই। ঊর্ধ্বতন রুশ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে মার্কিন নিষেধাজ্ঞা জারি রয়েছে নানা কারণে। রাশিয়া যেভাবে ইউক্রেনের ক্রাইমিয়া অঞ্চল দখল করে তা নিজদেশের অন্তর্ভুক্ত করেছে যা যুক্তরাষ্ট্রকে ক্ষিপ্ত করে। তাছাড়া অন্য দেশের নির্বাচনে রাশিয়া নাক গলায় এমন অভিযোগেও কিছু নিষেধাজ্ঞা দেয় যুক্তরাষ্ট্র।
দুজন সাবেক মার্কিন মেরিন সেনা এখন রুশ কারাগারে বন্দী। এদের একজন গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগে ১৬ বছরের সাজা খাটছে। দুই দেশের এই বৈরি সম্পর্কে আরও যুক্ত হয়েছে প্রেসিডেন্ট বাইডেনের একটি মন্তব্য। গত মার্চে এক সাক্ষাৎকারে প্রেসিডেন্ট বাইডেন তার সাক্ষাৎকার গ্রহণকারীর সঙ্গে একমত হন যে, ভ্লাদিমির পুতিন আসলে ”একজন খুনি”।
কিন্তু এত ঘটনার পরেও এই দুজন দুই দেশের প্রেসিডেন্ট হিসেবে এই প্রথম মুখোমুখি হবেন।
মস্কোর একটি থিংক ট্যাংক রিয়াকের পরিচালক আন্দ্রে কুর্টানভ বলেন, “প্রতীকী তাৎপর্যের কথা বিবেচনা করলে এই শীর্ষ বৈঠক বেশ গুরুত্বপূর্ণ; এটি রাশিয়াকে যুক্তরাষ্ট্রের পাশে এক কাতারে স্থান দিচ্ছে। পুতিনের কাছে এই প্রতীকী ব্যাপারটা কম গুরুত্বপূর্ণ নয়।”
এই বৈঠকটি হচ্ছে হোয়াইট হাউজে আসার পর প্রেসিডেন্ট বাইডেনের প্রথম বিদেশ সফরের সময়। তিনি নিজেই এরকম একটি বৈঠকের অনুরোধ জানিয়েছিলেন। এটা কিন্তু ভ্লাদিমির পুতিনের জন্য বোনাস। এটি একটি পূর্ণাঙ্গ শীর্ষ বৈঠক, অন্য কোন অনুষ্ঠানের ফাঁকে কোন সংক্ষিপ্ত সাক্ষাৎ নয়।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের ইউরোপ সফর বেশ ব্যস্ততার মধ্যেই কাটছে। তিনি সোমবার ব্রাসেলসে নেটোর সদর দফতরে বৈঠক করবেন। কিন্তু তারপরও ইউরোপে তার সফর-সূচির শেষ গন্তব্য নিয়ে আগ্রহের কমতি নেই- ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে তার একান্ত বৈঠকটি হবে বুধবার, জেনেভায়।
ভ্লাদিমির পুতিন এবং জো বাইডেনের শীর্ষ বৈঠকটি হবে জেনেভায়। তাদের বৈঠকের জন্য জেনেভাকে বেছে নেয়ার সিদ্ধান্ত স্নায়ুযুদ্ধের সময় ১৯৮৫ সালে আরেকটি শীর্ষ বৈঠকের কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে। সেই বৈঠকে প্রথম মুখোমুখি হয়েছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগ্যান এবং সোভিয়েত নেতা মিখাইল গরবাচভ।
কিন্তু এমন সম্ভাবনা খুবই কম যে এ সপ্তাহের শীর্ষ বৈঠকটি সেই বৈঠকের মতো কিছু হবে। রেগ্যান এবং গরবাচভ যেভাবে ব্যক্তিগত সুসম্পর্ক স্থাপন এবং রাজনৈতিক বরফ গলাতে সক্ষম হয়েছিলেন, পুতিন-বাইডেন বৈঠক থেকে সেরকম কিছু আশা করা হচ্ছে না।
হোয়াইট হাউস বলছে, তারা রাশিয়ার সঙ্গে একটি স্থিতিশীল এবং অনুমানযোগ্য সম্পর্ক বজায় রাখতে চায়। কিন্তু মি. পুতিনের কাজের ধারা একেবারেই ভিন্ন। তিনি ২০১৪ সালে যখন সৈন্য পাঠিয়ে ইউক্রেনের কাছ থেকে ক্রাইমিয়া দখল করে নিলেন, এই অঞ্চলটিকে নিজ দেশের অন্তর্ভুক্ত করলেন, তখন হতে তাকে নিয়ে দুশ্চিন্তা তৈরি হয়েছে। তিনি এরপর কী করবেন, সেটা কেউ অনুমান করতে পারছেন না। রাশিয়ার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের টানাপোড়ন শুরু তখন থেকে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক লিলিয়া শেভটসোভা মনে করেন, এই শীর্ষ বৈঠকের একটি সম্ভাব্য লক্ষ্য হতে পারে, দুপক্ষের ”রেড লাইন” বা সর্বশেষ সীমারেখা কোথায় সেটা পরীক্ষা করে দেখা। “সেই সঙ্গে এরকম একটা উপলব্ধিতে পৌঁছানো যে, আলোচনার মাধ্যমেই এই অতল গহ্বর হতে উঠে আসতে হবে।”
তিনি আরও বলেন, “যদি দুপক্ষ কোন কথা-বার্তা না বলে, তখন রাশিয়ার ভাবগতি অনুমান করা আরও বেশি কঠিন হয়ে পড়বে।”
ভ্লাদিমির পুতিন এ সপ্তাহে রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনকে দেয়া সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, “কিছু বিষয় আছে যেখানে আমরা যুক্তরাষ্ট্রের সাথে এক সঙ্গে কাজ করতে পারি।” এর মধ্যে আছে পরমাণু অস্ত্র নিয়ন্ত্রণের জন্য নতুন করে আলোচনা, সিরিয়া এবং লিবিয়ার পরিস্থিতি সহ বিভিন্ন আঞ্চলিক সংঘাত নিরসনে আলোচনা এবং জলবায়ুর পরিবর্তনের মতো বিষয়। পুতিন বলেন, “যদি আমরা এসব বিষয়ে কাজ করার একটি কৌশল খুঁজে পাই, তাহলে আমরা বলতে পারবো এই শীর্ষ বৈঠক ব্যর্থ হয়নি।”
পুতিন সম্প্রতি পশ্চিমা দেশগুলোকে এক বৈরি শক্তি বলে বর্ণনা করেছেন।
এ মাসে সেইন্ট পিটার্সবার্গে অর্থনৈতিক ফোরামের এক সম্মেলনে তিনি বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র আসলে রাশিয়া উন্নয়নকে আটকে দিতে চায়।
এর কয়েকদিন আগে তিনি হুমকি দিয়েছিলেন, কোন বিদেশি আগ্রাসী শক্তি যদি ”রাশিয়াকে দংশন করতে চায়”, তিনি তাদের দাঁত ভেঙ্গে দেবেন। তিনি বলেছিলেন, রাশিয়া তার মর্যাদা এবং শক্তি ফিরে পেয়েছে, বাকী বিশ্বের এ বিষয়টি মনে রাখা দরকার। মিস্টার কুর্টানভ বলেন, “এটা পরিষ্কার যে, তিনি বিশ্বাস করেন যুক্তরাষ্ট্র তাদের শত্রু, তারা রাশিয়ার ভালো চায় না। আমার মনে হয় না, যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাপারে তার এই দৃষ্টিভঙ্গির কোন পরিবর্তন হবে।”
তবে তা সত্ত্বেও রাশিয়া হয়তো বর্তমান উত্তেজনা কিছুটা কমিয়ে আনার কথা ভাবছে।
“একজন জাতীয়তাবাদী নেতা হিসেবে পুতিন হয়তবা চাইবেন এই বৈরি সম্পর্কের যে মূল্য এবং ঝুঁকি, সেটা কমিয়ে আনতে,” বলছেন মিস্টার কুর্টানভ।
এর মধ্যে আছে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার মতো বিষয়। সর্বশেষ নিষেধাজ্ঞার ফলে রাশিয়ার পুঁজি সংগ্রহের ক্ষমতা কমে এসেছে। নতুন নিষেধাজ্ঞার প্রভাব হয়তো আরও অনেক ক্ষতি করবে। নির্বাচনের বছরে এর একটা বিরাট চাপ পড়তে পারে অর্থনীতির উপর।
“দেশের ভেতর যখন অনেক জ্বলন্ত সামাজিক এবং অর্থনৈতিক সমস্যা, তখন কিন্তু রুশ জনগণের মোটেই আগ্রহ নেই ”পররাষ্ট্রনীতির আরেকটি বিজয় দেখার”, বলছেন মিস্টার কুর্টানভ।
“পুতিন যেটাই চান না কেন, আমার মনে হয় না উত্তেজনা আরও বাড়িয়ে তিনি দেশের রাজনীতিতে কোন ফায়দা পাবেন।”
মানবাধিকার নিয়ে বকা-ঝকা:
মিস্টার পুতিন আর যাই চান, মানবাধিকার নিয়ে কোন কথা আসলে শুনতে চান না। রাশিয়ার বন্দী বিরোধী রাজনীতিক আলেক্সেই নাভালনির ব্যাপারে তো নয়ই।
মস্কোর এটি আদালত মিস্টার নাভালনির রাজনৈতিক দপ্তর এবং তার দুর্নীতি বিরোধী সংস্থাকে ”চরমপন্থী” বলে বর্ণনা করে নিষিদ্ধ করেছে। আদালতের এই রুলিং কিন্তু ইচ্ছে করলেই শীর্ষ বৈঠক না হওয়া পর্যন্ত পিছিয়ে দেয়া যেতে পারতো।
কিন্তু তার পরিবর্তে এই সময়ে আদালতের এই রুলিং এর মাধ্যমে যেন একটি বার্তা দেয়া হলো: আর সেটি হচ্ছে, ভ্লাদিমির পুতিন ভিন্নমত দমন অব্যাহত রাখবেন, এবং এটাতে মার্কিনীদের নাক গলানোর কোন অধিকার নেই। লিলিয়া শেভটসোভা বলছেন, “প্রেসিডেন্ট বাইডেন তার গান গেয়ে যাবেন- নাভালনি এবং মানবাধিকার নিয়ে; এরপর পুতিন তার গান গাইবেন, বলবেন, যুক্তরাষ্ট্রের পরিস্থিতিও তো একই রকমের।”
“তবে এরকম একটা বৈঠক যখন হচ্ছে, তখন আমরা ধরে নিতে পারি মানবাধিকার নিয়ে অল্প বাকবিতণ্ডার পর তারা মূল আলোচনার বিষয়ে চলে যাবেন, এবং সেটা হচ্ছে, কীভাবে উত্তেজনা কমিয়ে আনা যায়।”
সূত্র : বিবিসি বাংলা।
Leave a Reply