এএ আজাদ হান্নান, ঈশরদী: লক্ষিকুন্ডা ইউনিয়নসহ ঈশরদীর বিভিন্ন এলাকায় চলতি মৌসুমে অবৈধভাবে ৫৩ টি ভাটায় ইট উৎপাদন করা হচ্ছে। তিনটি ভাটায় বৈধভাবে ইট উৎপাদন করা হচ্ছে। অর্থাৎ প্রায় ৫৬ টি ইট ভাটার মধ্যে ৫৩ টি ইট ভাটার পরিবেশের ছাড়পত্রসহ কোন বৈধ কাগজ নেই। এখানেই শেষ না। ৫৩ টি অবৈধ ভাটার মধ্যে অন্তত:৩০/৩৫ টি ইট ভাটা ভ’মিহীনদের নামে বরাদ্দকৃত সরকারী খাস জমিতে গড়ে উঠেছে। আবার এই ইট ভাটাগুলিতে যে মাটি ব্যবহার করা হচ্ছে তাও সরকারী পদ্মা নদীর মাটি ব্যবহার করা হচ্ছে।
এছাড়াও প্রায় প্রত্যেকটি ইটভাটায় পোড়ানো হচ্ছে কাঠ। শুধুকি তাই ? সকল ভাটায় সরকার নির্ধারিত সাইজ থেকে ছোট করে ইট তৈরী করে বিক্রির মাধ্যমে ক্রেতাদের সাথে প্রতারনা করা হচ্ছে। ঈশ^রদী কাষ্টম,এক্সসাইজ এ্যান্ড ভ্যাট সার্কেল ঈশরদী অফিসে খাতা কলমে সব ইটভাটার হিসাব নেই। ইট তৈরী ও বিক্রি ঠিকই হচ্ছে কিন্তু রাজস্ব সরকারী অফিসে জমা হচ্ছেনা। এক্ষেত্রে ঐসব অফিসের কতিপয় কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা সুবিধা নিচ্ছেন।
এতে চলতি মৌসুমে শুধু ইটভা থেকে সরকার অন্তত:১০ কোটি টাকার রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হবে। এ্কই সাথে ঈশরদীর লক্ষিকুন্ডা ও সাহাপুর ইউনিয়নে শশ কোটি টাকা দিয়ে সরকার জনস্বার্থে বিভিন্ন পাকা রাস্তা নির্মাণ করেছিল। সে সব রাস্তাগুলি দিয়ে ইট ও মাটি বহনের ড্রাম ট্রাকসহ বিভিন্ন যানবাহন চলাচল করায় ধ্বংস হয়েছে। ধ্বংস রাস্তাগুলি এখন ধুলার ফ্যাক্টরী ও মরাখাদে পরিণত হয়ে একদিকে চলাচলের অযোগ্য হয়ে পড়েছে ।
অন্যদিকে আসছে বন্যা মৌসুমে পদ্মানদীতে পানির চাপ শুরু হলে যে কোন স্থানে বাঁধ ভেঙ্গে গেলে রাশিয়ানদের জন্য নির্মিত গ্রীণসীটিসহ ঈশরদী এলাকা তলিয়ে যাওয়ার আশংকা সৃষ্টি হয়েছে অনেকের মধ্যে। এলাকার অনেক ফসলী জমির ফসল নষ্ট হচ্ছে ধুলাবলিতে। অনেকেই চর্মরোগসহ নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। বীর মুক্তিযোদ্ধা ও প্রধান শিক্ষক সিরাজ উদ্দিন বিশ্বাসসহ লক্ষিকুন্ডা ও সাহাপুর ইউনিয়নের একাধিক দায়িত্বশীল সূত্রের দেওয়া অভিযোগে এসব তথ্য জানাগেছে।
সূত্রমতে,আইনের প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে এবং এলাকাবাসীর বাধা-নিষেধের তোয়াক্কা না করেই প্রকাশ্যে কাঠ দিয়ে ইট পোড়ানো হচ্ছে বৈধ অবৈধ ইট ভাটা গুলিতে। ফসলি জমি, ফলদ ও বনজ বাগান, বাসাবাড়ি সংলগ্ন এবং চলাচলের রাস্তাসহ ঘন বসতিপ‚র্ণ এলাকায় অবৈধ ইট ভাটাতে প্রকাশ্যেই ইট পোড়ানো হচ্ছে। এতে জমির উৎপাদন যেমন কমছে,তেমনি উৎপাদিত ফসলও নষ্ট হচ্ছে। একই কারণে এলাকার বনজ সম্পদ উজাড় হয়ে পরিবেশে তার ভারসাম্য হারাচ্ছে।
অপরদিকে কাঠ দিয়ে ইট পোড়ানোর ফলে কালো ধোঁয়ায় চর্মরোগ, সর্দি কাশিসহ শ্বাসকষ্টের ঝুঁকিও বাড়ছে। বিশেষ করে শিশু ও বয়স্করা স্বাস্থ্যা ঝুঁকিতে রয়েছেন। ইট ও কাঠ বহণে রাস্তা ব্যবহার করায় শশ কোটি কোটি টাকা দিয়ে তৈরী রাস্তাগুলিও ধবংস হয়ে ধুলার ফ্যাক্টরী ও মরাখালে পরিণত হয়েছে। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল সকলেরই কমবেশী জানা আছে। এলজিইডি থেকে রাস্তা রক্ষায় বিভিন্ন রাস্তার গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে তৈরী করা লোহার বারগুলোও ভেঙ্গে দেওয়া হয়েছে। এলজিইডির রাস্তা রক্ষার পরিকল্পনা ভেস্তে গেছে বলে জানিয়েছেন উপজেলা প্রকৌশলী এনামুল কবীর।
সূত্রমতে,ঈশরদী কাষ্টম,এক্সসাইজ এ্যান্ড ভ্যাট সার্কেল ঈশরদী অফিসে খাতা কলমে সব ইভাটার হিসাব নেই। কারণ সব ভাটার হিসাব রাখলে ব্যক্তিগত আয় হয়না। হিসাবের বাইরের ভাটা থেকে অবৈধভাবে চুক্তি মোতাবেক অর্থ নেওয়া হয়। এতে সরকার পড়ছে রাজস্ব ফাঁকির গেড়াকলে । কতিপয় ভাটা মালিকদের সাথে অত্র অফিসের গোপন চুক্তি রয়েছে।
মৌসুম শুরুতেই অনিয়মের সাথে জড়িত ভাটা মালিকরা ভাটা প্রতি দেড় লাখ টাকা করে প্রায় এক কোটি টাকা টাকা চাঁদা তুলে কাষ্টমসের রাজস্ব কর্মকর্তাসহ কতিপয় দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের মধ্যে বন্টন করেছে। এজন্য সরকারী জমির মাটি ব্যবহার করে, কয়লার পরিবর্তে কাঠ পুড়িয়ে এবং ইটের সরকার নির্ধারিত সাইজ কমিয়ে তৈরী করা ইট প্রকাশ্যে কাষ্টম অফিসের সামনে দিয়ে নিয়ে ঈশরদী শহরসহ বিভিন্ন এলাকায় বিক্রি করা হলেও কাষ্টম কর্মকর্তা কোন ব্যবস্থা নেননি।
এমনকি অন্যকারও তেমন মাথা ব্যথা আছে বলে মনে হয়না।শুধুমাত্র উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে সম্প্রতি দু’একবার মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করে কয়েকটি ভাটা মালিককে জরিমানা করার নজির রয়েছে। লক্ষিকুন্ডা ইউনিয়ন পরিষদে প্রায় দেড় কোটি টাকা ইউনিয়ন পরিষদের ট্যাক্স দেওয়ার খবর শোনা গেছে।
লক্ষিকুন্ডার বিভিন্ন এলাকায় পরিবেশ অধিদফতরের ছাড়পত্র ছাড়াই বেশীরভাগ ভাটায় ইট পোড়ানো হচ্ছে। অবৈধ ইট ভাটার কারণে ফসলি কৃষি জমির উপরি অংশ, সরকারী খাল ও নদীর মাটি অবৈধভাবে খনন করে ইট তৈরির কাজে ব্যবহার করছে। একইভাবে আম, জাম, কাঁঠাল রেন্ট্রি, মেহগনিসহ বিভিন্ন প্রজাতির গাছ ইট পোড়ানোর কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে। এ সব অবৈধভাবে গড়ে ওঠা ভাটার নেই কোন বৈধ কাগজ পত্র।
সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অনুমতি না থাকলেও অসাধু মালিকরা প্রকাশ্যে কাঠ দিয়ে ইট পোড়লেও রহস্যজনক কারণে কর্তৃপক্ষ নীরব। পরিবেশ রক্ষায় ও ট্যাক্স আদায়ে সরকার এ অবৈধ ভাটার বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানে থাকলেও এলাকার প্রভাবশালী মহল সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীলদের ম্যানেজ করে বসতবাড়ি ও হাট-বাজার, রাস্তার পাশে অবৈধ ইট ভাটা তৈরি করে ইট তৈরী করে যাচ্ছে দেদারছে।
লক্ষিকুন্ডা ইউনিয়নের একাধিক ভুক্তভোগীরা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান,হাতেগোনা কয়েকজন প্রভাবশালী ব্যক্তি প্রতি বছর পরিবেশ অধিদপ্তরসহ সংশ্লিষ্টদের সাথে আতাত করে সরকারী নদীর জমিতে ভাটা দিয়ে নদীর মাটি কেটে এবং কাঠ পুড়িয়ে ইট তৈরী করে বাজারজাত করে যাচ্ছে। কাষ্টম অফিসের সাথেও তাদের চুক্তি রয়েছে তাই ভাটা মালিকরা বেপরোয়াভাবে এই ব্যবসা চালিয়ে গেলেও কারও কোন অসুবিধা হয়না। বাড়ির সামনে ফসলি জমিতে অবৈধ ভাটার আগুনের কালো ধোঁয়ার কারণে ফলদ ও বনজ বাগানের গাছের পাতা কালো হয়ে ঝড়ে পরে এবং ফল নষ্ট হয়ে যায়। চলতি বছরেও ইট তৈরি করতে দেখে আতঙ্কের মধ্যে আছে তারা। কোথায় গেলে এ ইট পোড়ানো বন্ধ করা যাবে তাও তারা বুঝতে পারছেন না।
তারা বলেন, শুনেছি এদের বিরুদ্ধে অভিযোগ দিয়ে কোন লাভ নাই। ভাটাতে কাঠ দিয়ে আগুন দেয়ার সময় কালো ধোঁয়ায় শ্বাসকষ্টসহ স্বাস্থ্যা ঝুঁকি বেড়ে যাওয়াসহ সড়কে যান চলাচলের দুর্ভোগ পোহাতে হয়। এদিকে ঐসব অবৈধ ভাটা মালিক পক্ষ সকল প্রকার অভিযোগ অস্বীকার করে বলছেন তারা বৈধভাবে ইট তৈরী ও বিক্রি করছেন। কোন প্রকার অবৈধ কাজ করছেন না।
ইতি মধ্যে অবৈধ ভাটায় কাঠ পোড়ানোর দায়ে তিনটি ভাটা মালিকের জরিমানা করা হয়েছে। ঈশরদী উপজেলা প্রকৌশলী এনামুল কবীর বলেন,প্রায় এক’শ কোটি টাকা ব্যয়ে তৈরী করা রাস্তা গুলিকে রাক্ষার জন্য লক্ষিকুন্ডা ও সাহাপুর ইউনিয়নের গুরুত্বপূর্ণ পাঁচ পয়েন্টে প্রায় এক লাখ টাকা ব্যয়ে পাঁচটি লোহার বার তৈরী করা হয়েছিল। অবৈধ যানবাহন চালানোর জন্য রাতের অন্ধকারে সে বার গুলি ভেঙ্গে দেওয়া হয়েছে অনেক আগেই।
ঈশরদী উপজেলা নির্বাহী অফিসার কায়ৃালয়ের একটি দায়িত্বশীল সুত্র জানায়, যে কোন প্রকার অবৈধ কাজের বিরুদ্ধে প্রশাসন জিরো টলারেন্স অবস্থায় আছে। অভিযোগ পাওয়ায় ইতিমধ্যে কয়েকটি ভাটা মালিককে জরিমানা করা হয়েছে।
ব্যক্তিগত ভাবে নিয়োগকৃত ব্যক্তিদের দিয়ে অবৈধ ইট ভাঁটার মালিক,বিড়ি ফ্যাক্টরীর মালিক,বিভিন্ন শিল্প কারখানা ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মালিকদের ভ্যাট কমিয়ে ব্যক্তিগত ভাবে মোটা অংকের টাকা হাতিয়ে নেওয়ায় কোটি কোটি টাকা সরকারী রাজস্বের ক্ষতি করছেন অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে ঈশরদী কাস্টম,এক্সসাইজ এ্যান্ড ভ্যাট সার্কেল অফিসের রাজস্ব কর্মকর্তা জাহাঙ্গীর আলম জানান, এসব অভিযোগের বিষয়ে এবং আগে কি হয়েছে তা আমার জানা নেই কারণ আমি চলতি মাসেই যোগদান করেছি। রাজস্ব আদায় করা আমার কাজ তাই যোগদানের পর থেকে সকলকে সাথে নিয়ে সঠিকভাবে রাজস্ব আাদায়ের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি ।
পরিবেশের ছাড়পত্র ছাড়াই কিভাবে ঈশ^রদীতে ইটভাটায় ইট উৎপাদন হচ্ছে এবং পরিবেশের ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে অবৈধ ইটভাটার কারণে তা জানার জন্য একাধিকবার ফোন করেও পরিবেশ অধিদপ্তর পাবনার সহকারী পরিচালক নাজমুল হক ফোন রিসিভ করেননি।
Leave a Reply