তৌহিদ আক্তার পান্না,ঈশ্বরদী: বাংলাদেশ রেলওয়ের পশ্চিমাঞ্চলে ঘন ঘন দূর্ঘটনার কারণে রেলওয়ে দিনদিন আর্থিক ক্ষতির সম্মুখিন হচ্ছে। এ অঞ্চলে একবার দুর্ঘটনা ঘটলে সহজে তার সমাধান হয় না । গত ২ থেকে ৯ মে/২৪ ইং তারিখের মধ্যে এক সপ্তাহে তিনটি ট্রেন দুর্ঘটনা ঘটে। এতে একদিকে ট্রেনের মারাত্বক শিডিউল জটিলতার সৃষ্টি হয়। অন্যদিকে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষকে বড় ধরনের আর্থিক ক্ষতির সম্মুখিন হতে হয়েছে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষকে।
গত ১০ মে বৃহস্পতিবার ভোরে ঈশ্বরদীর মাঝগ্রাম স্টেশনের নিকট বুড়িমারী এক্সপ্রেস ট্রেন দূর্ঘটনার সম্মুখিন হয়। এতে উত্তর,পশ্চিম ও ঢাকা অঞ্চলের ট্রেনগুলোর চলাচলে সিডিউল বিপর্যয় ঘটে। ঐঘটনার পর থেকে দেখা যায় ঢাকাসহ বিভিন্ন রেলওয়ে স্টেশনে টানা প্রায় এক সপ্তাহের মতো পশ্চিমাঞ্চলের ট্রেনগুলো দীর্ঘক্ষণ দেরি করে স্টেশন ছাড়ছে।
রেলওয়ের সূত্রমতে, ঢাকা থেকে উত্তর ও পশ্চিমাঞ্চলের মধ্যে প্রতিদিন ২৩টি ট্রেন চলাচল করে। এরমধ্যে ১৯টি আন্তঃনগর, একটি মেইল ট্রেন ও তিনটি কমিউটার ট্রেন রয়েছে। এই ট্রেন গুলির মধ্যে ঢাকা থেকে জয়দেবপুর হয়ে বঙ্গবন্ধু বহুমুখী সেতু দিয়ে ঈশ্বরদীর মধ্যে ১৯ টি ট্রেন ও ঢাকা থেকে পদ্মা
সেতু হয়ে চলাচল করে চারটি ট্রেন। পদ্মা সেতু হয়ে যাওয়া মধুমতী এক্সপ্রেস,বেনাপোল এক্সপ্রেস, নকশীকাঁথা এক্সপ্রেস ও সুন্দরবন এক্সপ্রেস ছাড়া ১৯টি ট্রেনই প্রায় চল্লিশ মিনিট থেকে ৮ ঘণ্টা পর্যন্ত দেরিতে চলাচল করেছে বলে নিশ্চিত করেছেন ঢাকা রেলওয়ে স্টেশন মাস্টারদের একাধিক দায়িত্বশীল সূত্র।
বিভিন্ন দায়িত্বশীল সুত্র ও রেলওয়ে কর্মকর্তাদের সুত্রমতে, উল্লেখিত নয়দিনে তিনটি ট্রেন দুর্ঘটনায় ট্রেনের শিডিউল জটিলতা বৃদ্ধি,যাত্রী ভোগান্তির পেছনে ভিন্ন একটি কারণ উঠে জানাগেছে।
ঢাকা থেকে পশ্চিমাঞ্চলের মধ্যে প্রতিদিন ২৩টি ট্রেন চলাচল করে। এরমধ্যে ঢাকা থেকে জয়দেবপুর হয়ে ঈশ্বরদী রুটে প্রতিদিন ১৯ জোড়া ট্রেন চলাচল করলেও ঈশ্বরদী- জয়দেবপুর রুটের এই ট্রেনগুলিকে সিঙ্গেল লাইনে চলাচল করতে হয়। এ কারণে যে কোনো দুর্ঘটনা ঘটে শিডিউলের সামান্য হেরফের হলে দীর্ঘ যানজট তৈরি হয় ।
মাস্টার,পয়েন্সম্যান ও অন্যান্য জনবল সংকটের কারণে এ রুটের স্টেশনগুলো অনেক আগ থেকে বন্ধ রাখা হয়েছে। ফলে এই রুটে চলাচলকারী সকল ট্রেনকেই দীর্ঘ ক্রসিংয়ের শিকার হতে হয় ।
ট্রেনের শিডিউল জটিলতার কারণ হিসেবে পশ্চিমাঞ্চলের পাকশী বিভাগীয় ব্যবস্থাপক শাহ সুফি নূর মোহাম্মদসহ সংশ্লীষ্ট দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা জানান,বঙ্গবন্ধু রেলসেতুর কানেকটিং রেল লাইন,টঙ্গি-জয়দেবপুর ডাবল লাইনের কাজ,বিভিন্ন সেতুর কাজসহ বিভিন্ন উন্নয়ন মূলক কাজ চলমান থাকায় এবং সিনদিয়া স্টেশনসহ কোন কোন স্টেশনে ম্যানুয়াল সিগনেলিং ব্যবহার করায় সিডিউল বিপর্যয় হচ্ছে। ট্রেন দূর্ঘটনা একটি কারণ এবং ঈশ^রদী জয়দেবপুর রেললাইন ডাবল না হওয়াও আর একটি কারণ।
অনেক স্টেশন আধা ঘণ্টারও বেশি সময় অপেক্ষা করতে হয় জানিয়ে সুত্রজানায়, নাটোর থেকে আব্দুলপুর যেতে লাগে আধা ঘণ্টা। সময় কোনোভাবে এদিক-সেদিক একটি ট্রেন গেলে অন্যটির আধাঘণ্টা অপেক্ষা করতে হয়।
বঙ্গবন্ধু সেতু ট্রেন চলাচলে ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় নতুন করে বঙ্গবন্ধু রেলসেতু নির্মাণ করা হচ্ছে। বঙ্গবন্ধু সেতুতে ৪ দশমিক ৮ কিলোমিটার রেললাইন পার হতে ট্রেনগুলোর প্রায় ২০ মিনিট সময় লেগে যায় আর নতুন সেতুর ক্রসিং তৈরির জন্যে প্রতিটি ট্রেনের আরও ২০ মিনিট লেগে যাচ্ছে।
অন্যদিকে বঙ্গবন্ধু সেতু সিঙ্গেল লাইন হওয়ায় এ সময়ে অন্য ট্রেনকে স্টেশনে ৪০ থেকে ৫০ মিনিট অ অপেক্ষা করতে হচ্ছে। একইসঙ্গে এ এলাকার স্টেশনগুলোতেও রয়েছে জনবল সংকট। বঙ্গবন্ধু রেলসেতু প্রকল্পের অদক্ষ জনবল দিয়ে স্টেশন পরিচালনা করতে গিয়ে আরও গত সপ্তাহে মুখোমুখি অবস্থায় চলে গিয়েছিল দুই ট্রেন। দুর্ঘটনা থেকে অল্পের জন্যে রক্ষা পায় ট্রেন দুটি। এখনও সাধারণ পদ্ধতিতে ট্রেন চলে।
পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ে সূত্র বলছে, যমুনায় বঙ্গবন্ধু রেল সেতুর নির্মাণকাজ চলছে। এজন্য ট্রেন চলাচলে মাত্র দুটি লাইন সচল রয়েছে। সেখানে কম্পিউটার বেইজড ইন্টারলিঙ্ক সিস্টেম (সিবিআইএস) নেই। জয়দেবপুরেও নতুন রেললাইন নির্মাণ চলছে, নেই সিবিআইএস। এতে করে ট্রেন বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকছে। আবার প্রকল্প চলমান থাকায় অনেক জায়গায় সিবিআইএস চালু করা যাচ্ছে না। বলা যায়,সন্তান প্রসবের আগে প্রসূতির ব্যথা যন্ত্রনা হলেও পরবর্তীতে সে ব্যথা আর থাকেনা। অর্থাৎ ভাল কিছু পাওয়ার আগে একটু কষ্ট হতে পারে,আর এই কষ্টকে স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করতে হবে।
সূত্রমতে, পশ্চিমাঞ্চল রেলের রাজশাহী, দিনাজপুর, রংপুর লাইনের প্রতিটি ট্রেন সর্বনিম্ন দুই থেকে তিন ঘণ্টা পর্যন্ত বিলম্বে চলাচল করতে হচ্ছে। আবার রাজশাহী থেকে ঢাকাগামী চারটি আন্তঃনগর এক্সপ্রেস ট্রেন কয়েক ঘণ্টা দেরিতে চলাচল করছে।
উল্লেখ্য, গত ২ মে বগুড়ার সান্তাহার জংশন স্টেশনে যাত্রীদের সঙ্গে সংঘর্ষ, এর পরদিন ৩ মে জয়দেবপুরে মালবাহী ট্রেনের সঙ্গে যাত্রীবাহী ট্রেনের মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়। যেটা উদ্ধার করতে লেগে যায় ২৯ ঘণ্টা। এরপর ৯ মে ভোররাতে ঈশ্বরদী-ঢাকা রেলপথের মুলাডুলি-চাটমোহর রেলস্টেশনের মধ্যে মুলাডুলি স্টেশন অতিক্রম করে আউটার সিগন্যালে দুর্ঘটনা ঘটে।
Leave a Reply